তুরাগ থেকে মনির হোসেন জীবন
রাজধানীর তুরাগে ব্যাঙ্গের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে অবৈধ ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা গ্যারেজ ও চার্জিং পয়েন্টের ছড়াছড়ি। সরকারি আইন ও নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে গড়ে তোলা হয়েছে শতশত রিকশার গ্যারেজ। সেই সাথে প্রতিটি গ্যারেজে রয়েছে একাধিক চার্জিং পয়েন্টও। তবে রাতারাতি গড়ে উঠা এসব গ্যারেজ ও চার্জিং পয়েন্টের নেই বৈধ কোনো অনুমতি। আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তুরাগ থানার ছোট বড় ৩৩টি গ্রামে এক শ্রেণির রিকশার গ্যারেজ মালিক এই ব্যবসা দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছেন। গ্যারেজগুলোর বিদ্যুতের সংযোগ বৈধ না অবৈধ, তা নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন। উত্তরা বিভাগের বিভিন্ন এলাকায় এ অবৈধ ব্যবসা করে রাতারাতি অনেকে লাখোপতি কিংবা কোটিপতি বনে গেছেন। সরকার এই খাত থেকে বছরে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব আদায় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
খোঁজ খবর নিয়ে এবং তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজধানীর সর্ব উত্তরের থানার নাম তুরাগ। দেশে ১৯৮৮ সালে ভয়াবহ বন্যার পর তৎকালীন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সরকারের শাসনামলে আব্দুল্লাহ থেকে মিরপুর পর্যন্ত তুরাগ (কহরদরিয়া) নদীর পাশ দিয়ে উঁচু করে এ বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেরিবাধটি স্থাপন করা হয়। এছাড়া এ বেরিবাধ সড়ককে ঘিরে সরকারি ও বেসরকারি জমির ওপর বস্তিঘর বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও অবৈধ কয়েকশ গ্যারেজ ও চার্জিং পয়েন্ট গড়ে উঠেছে। সরজমিন ঘুরে দেখা গেছে, সরকারি পরিত্যক্ত জমি, মূলত খালি প্লটে টিন-বাঁশ দিয়ে বা বড় টিনশেড ঘরকে গ্যারেজ ও চার্জিং পয়েন্ট বানানো হয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যক্তি মালিকানাধীন জমিতে ঘর তুলে ব্যাটারি চালিত রিকশার গ্যারেজ ভাড়া দেয়া হয়েছে। প্রতিটি গ্যারেজে মাচা ও মাটির ফ্লোর কিংবা কাঁঠের চকিতে রিকশাচালকদের রাত কিংবা দিনের বেলায় ঘুমানোর ব্যবস্থা করা রয়েছে। যে গ্যারেজে চালকরা ঘুমায় সেখানেই অটোরিকশা রেখে ব্যাটারি চার্জ দেওয়া হয়। নাম মাত্র বৈদ্যুতিক মিটার ঝুলানো আছে। রাত দিন চলে ব্যাটারি চার্জ, প্রতিটি গ্যারেজে আছে একাধিক চার্জিং পয়েন্টও। গড়ে উঠা এসব গ্যারেজ ও চার্জিং পয়েন্টের নেই কোনো অনুমতি।
সরকারি ও বেসরকারি একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তালিকা অনুযায়ী, তাদের ৮ অপরাধ বিভাগের মধ্যে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার অবৈধ সংখ্যা ৪৮ হাজার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে প্রায় ৬৫ হাজার দাঁড়িয়েছে। এর পাশাপাশি ৯৯২টি গ্যারেজে ১৩৬টি চার্জিং পয়েন্ট ও রয়েছে। দিনকে দিন এর সংখ্যা পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলেছে।
পুলিশের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, ডিএমপির উত্তরা বিভাগের ছয় থানা এলাকায় ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা ও চার্জিং পয়েন্টের সংখ্যা তুলনামূলক ভাবে কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তার মধ্যে তুরাগ, দক্ষিণ খান, উত্তর খান, বিমানবন্দর, উত্তরা পশ্চিম ও উত্তরা পূর্ব বিশেষ ভাবে উল্লেখ যোগ্য। তবে তুরাগ, দক্ষিণখান, উত্তরখান ও উত্তরা পশ্চিম থানা এলাকায় রিক্সার সংখ্যা আগের তুলনায় ব্যাঙ্গের ছাতার মতো বেড়েছে। এসব থানা এলাকায় গড়ে উঠা একেকটি গ্যারেজে ৩০ থেকে ১০০টি পর্যন্ত রিকশা রাখা হয়। প্রতিটি গ্যারেজে রয়েছে চার্জ দেওয়ার সুবিধা। চার্জে অনেক বিদ্যুৎ লাগে। গ্যারেজগুলোর বিদ্যুতের সংযোগ বৈধ না অবৈধ, তা নিয়েও প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। অনুমোদন ছাড়াই চলাচল করা ব্যাটারিচালিত রিকশা, অটোরিকশা বা ইজিবাইকের এসব গ্যারেজ ও চার্জিং পয়েন্টেরও কোনো অনুমতি নেই। এরপরও কিছুর ধার না ধেরে বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে এমন অসংখ্য অবৈধ গ্যারেজ ও চার্জিং পয়েন্ট। এসব যানবাহনের কারণে মাঝেমধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় যেমন হয়, ঠিক তেমনি রাস্তা ঘাটে যানজটের মূল কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
সূত্র গুলো বলছে, ডিএমপি’র মিরপুর বিভাগেই রয়েছে ৩৯ থেকে ৪২ হাজার চার্জিং পয়েন্ট। অবৈধ গ্যারেজ এবং চার্জিং পয়েন্টের তালিকা করেছে পুলিশ। গেল এপ্রিলে ডিএনসিসিতে ব্যাটারিচালিত রিকশার বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছিল পুলিশ। অবৈধ পন্থায় গড়ে উঠা গ্যারেজ গুলোতে রিকশা রাখার পাশাপাশি চার্জও দেওয়া হয়। মিরপুরের শাহ আলীর উত্তর বিশিল বউবাজারসহ বেড়িবাঁধসংলগ্ন বিস্তীর্ণ এলাকায় টিন ও বাঁশ দিয়ে তৈরি অসংখ্য ঘর। ঘরগুলো ব্যাটারিচালিত রিকশার (অটোরিকশা) গ্যারেজ ও চার্জিং পয়েন্ট (ব্যাটারি চার্জ দেওয়া হয়)। একেকটি গ্যারেজে ৭০ থেকে ১২০টি পর্যন্ত রিকশা রাখা হয়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সূত্র বলছে, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তালিকা অনুযায়ী, তাদের ১০ অপরাধ বিভাগের মধ্যে আট বিভাগে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার অবৈধ ৪৮ হাজার ১৩৬টি চার্জিং পয়েন্ট ও ৯৯২টি গ্যারেজ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে শুধু মিরপুর বিভাগেই রয়েছে ৩৯ হাজার ৮৩টি চার্জিং পয়েন্ট ও ২৫৯টি গ্যারেজ। বাকি দুই বিভাগ ধরলে ব্যাটারিচালিত রিকশার গ্যারেজ ১ হাজার ২৫০টির বেশি। প্রতিটি গ্যারেজে রয়েছে চার্জ দেওয়ার সুবিধা। প্রশাসনের পক্ষ থেকে গেল এপ্রিলে এসব অবৈধ চার্জিং পয়েন্ট ও গ্যারেজের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। পুলিশ ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) যৌথভাবে ব্যাটারিচালিত রিকশার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা ও নিয়েছিল।
উত্তরা বিভাগের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, কোনো কোনো ওয়ার্কশপেও চার্জ দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। কিছু এলাকায় কেবল চার্জ দেওয়ার জন্য চার্জিং পয়েন্ট খোলা হয়েছে। অধিকাংশ চার্জিং পয়েন্টে বিদ্যুৎ-সংযোগ নেওয়া হয়েছে আবাসিক লাইন থেকে, যা বিদ্যুৎ আইনের পরিপন্থী। দৈনিক ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা জমায় অটোরিকশা চালান। দিন শেষে গ্যারেজে ৪০০,৫০০ ও ৬০০ টাকা দেন। চার্জ দেওয়া, রিকশার মেরামত—সবই মালিক দেখেন। গ্যারেজে অনেক লাইন থাকে, কিছু মিটারও দেখেছেন। তবে এগুলো বৈধ না অবৈধ, তা তাঁরা জানেন না। কোন কোন গ্যারেজে চালকদের খাবারের জন্য (ম্যাচ) রান্নার ও আয়োজন রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উত্তরা ট্রাফিক বিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, মাঝে মাঝে ব্যাটারি চালিত অটোরিকশার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হয়। অনেক সময় জরিমানাসহ রিকশা ড্রাম্পিং করা হয়। আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে।
পুলিশের সূত্র বলেছে, ব্যাটারিচালিত রিকশার অবৈধ গ্যারেজ ও চার্জিং পয়েন্টের বেশির ভাগ মিরপুর বিভাগের সাত থানা এলাকায়। থানাগুলো হলো-মিরপুর মডেল, পল্লবী, কাফরুল, শাহ আলী, দারুস সালাম, রূপনগর ও ভাষানটেক।
এসব বিষয় জানতে চাইলে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মো. সরওয়ার সাংবাদিকদের বলেন, ইতিমধ্যেই একটি তালিকা করা হয়েছে, এটি নিয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি’র) কাজ করছে। তারা যদি আমাদের তথা পুলিশের সহায়তা চায়; তাহলে সর্বাত্মক সহায়তা করা হবে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

সর্বশেষ সংবাদ